Monday, May 3, 2021

এমপিও নীতিমালা ২০২১ । Mpo nitimala 2021. নতুন এমপিও নীতিমালাতে যেসকল বিষয় সুবিধা থাকছে

 ২৮ মার্চ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো এবং এমপিও নীতিমালা প্রকাশ করা হয়েছে। ইতঃপূর্বে মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো এবং এমপিও নীতিমালা প্রকাশ করা হয়। এ দুই নীতিমালা জারি হওয়ার ভেতর দিয়ে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য নীতিমালা প্রণয়নের কাজ সম্পূর্ণ হলো।

নীতিমালা প্রণয়নে এক বছরের অধিককাল সময় ব্যয় হয়। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর ভাষ্যমতে, স্কুল ও কলেজের নীতিমালা প্রণয়নে ১৪টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি সভার স্থায়িত্বকাল ছিল পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। অবশেষে প্রতীক্ষিত সহজবোধ্য এমপিও নীতিমালা প্রকাশিত হওয়ায় মন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধন্যবাদ জানাই। এখন এ নীতিমালা অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নেই নীতিমালার সার্থকতা নিহিত।

নীতিমালা অনড় কোনো বিষয় নয়। সময় ও বাস্তবতার নিরিখে নীতিমালার শর্তাদি নির্ধারিত হয়। ২০২১ সালের নীতিমালায় ২০১৮ সালের জনবল কাঠামো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির শর্তের লক্ষণীয় পরিবর্তন আনা হয়েছে। নীতিমালায় কোনো দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত হলে পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিবর্তন কাম্য।

মোটাদাগে নীতিমালার দিক দুটো। একটি পদ-পদবির এবং অপরটি নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে শর্তাদি। প্রথমে পদ-পদবির পরিবর্তনটা দেখা যাক। নীতিমালায় জনবল কাঠামোর কতিপয় পদের ধরনে পরিবর্তনের পাশাপাশি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। সহকারী গ্রন্থাগারিক কাম ক্যাটালগার পদের পদমর্যাদা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। এদের পদমর্যাদা সুনির্দিষ্ট করে সহকারী শিক্ষক (গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান) করা হয়েছে। এ ইতিবাচক সিদ্ধান্তে পদের অবস্থানগত অস্পষ্টতা দূর হলো।

হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষকরা পেশাগত জীবনে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই পদে চাকরি করেন। বর্তমান নীতিমালায় কাম্য শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে ১০ বছর চাকরি পূর্তিতে সিনিয়র শিক্ষক হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। তখন বেতনের গ্রেডও একধাপ বাড়বে। এ পদোন্নতি সহকারী শিক্ষকদের ইতিবাচক প্রণোদনা জোগাবে।

কলেজের প্রভাষকরা স্বপদে এমপিওভুক্তির আট বছর সন্তোষজনক চাকরি পূর্তিতে মূল্যায়নের ভিত্তিতে মোট পদের অর্ধেকটায় সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। নীতিমালায় ডিগ্রি কলেজে এ নামে পদ বহাল থাকলেও উচ্চমাধ্যমিক কলেজে পদের নাম বদলে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক করা হয়েছে। যদিও উভয় পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া এবং বেতনের গ্রেড একই। উচ্চমাধ্যমিক কলেজের প্রভাষকরা পদোন্নতির নাম পরিবর্তনে মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন। আপত্তি থাকলে পদের নাম না বদলানোই সমীচীন।

অধিকাংশ স্কুল ও কলেজে গার্হস্থ্য বিজ্ঞান এবং চারু ও কারুকলা বিষয়ে নতুন শিক্ষক নিয়োগ পাবেন। গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বিষয় সাধারণত মেয়েরা পড়ে থাকে। বয়েজ স্কুলে এ বিষয়ে পড়া শিক্ষার্থী মিলবে না। কাজেই গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাপ্যতার শর্তজুড়ে দেওয়া সঙ্গত। আর চারু ও কারুকলার পাশাপাশি সঙ্গীত শিক্ষার্থীর সুকুমার বৃত্তি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সে কারণে সংগীতে উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের এ পদে নিয়োগ দেওয়া যায় কিনা সেটা বিবেচনা করা যেতে পারে।

গ্রেড-২০-এ কর্মচারীর সংখ্যা ৫। পদগুলো হলো-নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছনতাকর্মী, নৈশপ্রহরী, আয়া এবং অফিস সহায়ক। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈশপ্রহরী এবং অফিস সহায়ক (অন্য কথায় দপ্তরি) কর্মরত আছেন। অন্য তিনটি পদে কর্মচারী নিয়োগ দিতে হবে। এ পদগুলোর ভেতর নৈশপ্রহরী ছাড়া অন্য পদগুলো সমগোত্রীয়। নিুমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণি তিনটি। আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণি পাঁচটি। অন্যদিকে উচ্চমাধ্যমিক কলেজে শ্রেণি দুটি এবং ডিগ্রি কলেজে শ্রেণি চারটি কিংবা পাঁচটি। শ্রেণি সংখ্যার সঙ্গে শিক্ষার্থীর সংখ্যা জড়িত। এ হিসাবে প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিভেদে গ্রেড-২০-এর কর্মচারীর সংখ্যা একটু বেশ কম হতে পারে।

এবারে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির শর্তাদি দেখা যাক। ২০১৮ সালের নীতিমালায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির যোগ্যতা নির্ধারণে চারটি বিষয়ের ওপর নম্বর দেওয়া হয়। বিষয় চারটি হলো-একাডেমিক স্বীকৃতি, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এবং পাবলিক পরীক্ষায় পাশের হার। প্রতিটি বিষয়ে নম্বর ছিল ২৫। ২০২১-র নীতিমালায় একাডেমিক স্বীকৃতিতে নম্বর রাখা হয়নি। একাডেমিক স্বীকৃতি/অধিভুক্ত থাকা সাপেক্ষে অন্য তিনটি বিষয়ে ১০০ নম্বর বণ্টন করা হয়েছে। একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একাডেমিক স্বীকৃতির পর দীর্ঘ ১৫-২০ বছর পার করেছে।

একাডেমিক স্বীকৃতিতে নম্বর না থাকায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৈষম্যের শিকার হবে। গতবারের এমপিও নীতিমালা নির্ধারিত কাম্য শিক্ষার্থী, পরীক্ষার্থী এবং পাশের হার পূরণ করতে না পারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা বিগত দুই বছর নীতিমালার কাঙ্ক্ষিত মান অর্জনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।

এ তিনটি বিষয়ের মধ্যে পাশের হারের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর দায় বর্তালেও শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থীর সংখ্যাবৃদ্ধি পুরোপুরি প্রতিষ্ঠানের আয়ত্তে নেই। সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২০২১ সালের নীতিমালায় উল্লেখিত কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থীর সংখ্যা পূরণ করতে না পারলে ভবিষ্যতে আর এ দুই শর্ত পূরণ করতে পারবে কিনা সন্দেহ। এ অবস্থায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধুঁকে ধুঁকে মারা পড়বে নাকি বিকল্প কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে সেই প্রশ্নের মীমাংসা জরুরি।

নীতিমালায় সহশিক্ষা/পুরুষ কলেজের ন্যূনতম শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থীর সংখ্যা থেকে মহিলা কলেজে এ সংখ্যা কিছুটা কম রাখা হয়েছে। কিন্তু নিুমাধ্যমিক/মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সহশিক্ষা/বালক বিদ্যালয়ের মতো বালিকা বিদ্যালয়েও শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থী সংখ্যা একই। আমরা মনে করি, কলেজের মতো বালিকা বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা কম রাখা সমীচীন। যত্রতত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমতি প্রদান কাম্য শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থীর সংখ্যা পূরণে প্রধান বাধা।

উদ্বেগের বিষয় হলো, শিক্ষা মন্ত্রণালয় দূরত্ব ও জনসংখ্যার শর্ত পূরণ না করা সত্ত্বেও প্রায়ই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন দিয়ে থাকে। নতুন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হলে স্বাভাবিকভাবেই পার্শ্ববর্তী সমজাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পায়। এলাকা বিশেষে অতিরিক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেওয়ায় এমপিওপ্রত্যাশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থীর কাম্য সংখ্যা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। একটি উল্লেখযোগ্য নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো বিল্ডিং পায়নি। প্রতিষ্ঠাকালীন দুর্বল অবকাঠামো শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আকর্ষণ করতে পারছে না।

দেশের কোথায় কোন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের সুযোগ আছে তা নির্ধারণের জন্য একটি ব্যাপকভিত্তিক সমীক্ষা প্রয়োজন। ২২ মার্চ নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী পরিষদ রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে উপস্থাপিত ছয় দফা সুপারিশের প্রথমটি ছিল-শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এমন একটি অ্যাপ চালু করা যাতে বাংলাদেশের মানচিত্রের কোনো স্থানে ক্লিক করলে ওই স্থানে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে কী যাবে না তা নির্দেশ করবে। তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে অনাকাঙ্ক্ষিত চাপ আর থাকবে না। প্রাপ্যতাসাপেক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হলে সহজেই প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হবে।

বর্তমানে চতুর্দিকে একই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দূরত্ব এবং সন্নিহিত এলাকার জনসংখ্যার ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রাপ্যতা নির্ধারণে আরও কতিপয় বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা কেবল স্কুলে নয়, মাদ্রাসাতেও ভর্তি হয়। কোনো একটি এলাকায় কাছাকাছি স্কুল ও মাদ্রাসা থাকলে শিক্ষার্থীরা কম-বেশি ভাগ হয়ে যায়। আবার এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা কলেজ, কারিগরি কলেজ কিংবা ম্যাটস্-এ ভর্তি হতে পারে। কাজেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাপ্যতা নির্ধারণে নিকটবর্তী কেবল এক ধরনের নয়, সমজাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিবেচনায় নেওয়া সঙ্গত।

এসএসসিতে মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা এবং বিজ্ঞান বিভাগে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সংখ্যার ওপর কলেজে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীর জোগান নির্ভরশীল। মফস্বলে হাইস্কুলে নবম-দশম শ্রেণিতে মানবিক শাখায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এরপর ব্যবসায় শিক্ষা শাখার শিক্ষার্থী। বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থী সবচেয়ে কম। কোনো কলেজে ব্যবসায় শিক্ষা এবং বিজ্ঞান শাখায় প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষার্থী মিলবে কিনা বিভাগ অনুমোদনের আগে সেই পারিপার্শ্বিক হিসাবটা করতে হবে।

বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন ঘটেছে। ফলে এক স্থান থেকে সহজেই অন্য স্থানে যাওয়া যায়। কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের শহর এলাকার কলেজে ভর্তি হওয়ার ঝোঁক থাকে। এরূপ অন্যত্র গমন শিক্ষার্থীদের জনমিতিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এসব বিষয় বিবেচনায় এনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের অ্যাপ চালু করলে অতিরিক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন রোধ করা যাবে। সেইসঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনে ন্যূনতম শিক্ষার্থী নির্ধারণের পাশাপাশি সর্বোচ্চ শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সীমা বেঁধে দেওয়া প্রয়োজন।

এমপিও নীতিমালা প্রকাশের পর এনটিআরসিএ থেকে শূন্য পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এ এক শুভ উদ্যোগ। আমরা নীতিমালা অনুসরণ করে দ্রুত আবেদন গ্রহণ করে চলতি অর্থবছরে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি এবং একটি পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে নন-এমপিও সমস্যার সামগ্রিক সমাধান প্রত্যাশা করি।



No comments:

Post a Comment